প্রশ্নটি মূলত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্ন। মানুষের যৌন ঝোঁক, পরিচয় বা ভালোবাসার ধরন কখনোই সমাজের অনুমোদনের মোহতাজ নয়—এটা প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু তবুও দেখা যায়, মৌলবাদী গোষ্ঠী এই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়টিকেই তাদের ‘ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। তারা চরম আক্রোশ দেখায়, হুমকি দেয়, কখনো সহিংসতা পর্যন্ত ঘটায়। প্রশ্ন হলো—মানুষ কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে বা রাখবে না, তা নিয়ে মৌলবাদীরা এত ক্ষিপ্ত হয় কেন?
প্রথমত, মৌলবাদী রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো নিয়ন্ত্রণ—মানুষের জীবনযাপন, পোশাক, মত, বিশ্বাস, সম্পর্ক, এমনকি ব্যক্তিগত অনুভূতিতেও। যে সমাজে মৌলবাদের প্রভাব বেশি, সেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা মৌলবাদীদের তীব্র শত্রুতে পরিণত হয়। সমকামীদের অধিকার মানে হলো ব্যক্তি স্বাধীনভাবে নিজের পরিচয় ও সম্পর্ক নির্ধারণ করছে। এই স্বাধীনতার প্রকাশ তাদের ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। কারণ যেখানেই ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা বাড়বে, মৌলবাদের জঙ্গলতন্ত্র সেখানেই দুর্বল হবে।
দ্বিতীয়ত, মৌলবাদীরা সামাজিক ভয়ের রাজনীতি চালায়। তারা একটি কল্পিত ‘অপরাধী’ তৈরি করে সমাজকে বোঝাতে চায়—এই মানুষগুলো নাকি সমাজ, পরিবার, ধর্ম বা সংস্কৃতি নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে সহজেই ভয়, ঘৃণা ও বিভ্রান্তি তৈরি করা যায়। সমকামীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ছড়ানো তাই তাদের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির মতো—ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুসারী ধরে রাখতে চায়। অথচ বাস্তবতা হলো, কোনো মানুষের যৌন পরিচয় কারও জীবন, ধর্ম, বিশ্বাস, বা সমাজ ভাঙে না। সমাজ ভাঙে ঘৃণা, সহিংসতা ও অন্ধ-অনুসরণের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, আমাদের উপমহাদেশে মিথ, ভুল ব্যাখ্যা ও অজ্ঞতার মাধ্যমেই সমকামীদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব তৈরি করা হয়েছে। অনেকেই সমকামিতাকে “অস্বাভাবিক”, “বাধা-বিপত্তির কারণ”, কিংবা “পশ্চিমাদের প্রভাব” হিসেবে তুলে ধরেন। অথচ ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য—সবখানেই সমলিঙ্গ ভালোবাসার উপস্থিতি আছে। এ বিষয়টি মানুষের জন্মগত বা স্বাভাবিক বৈচিত্র্যের অংশ—বিজ্ঞানও বহু আগেই তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু মৌলবাদী শক্তিগুলো এসব বিজ্ঞানের তথ্যকে অস্বীকার করে, কারণ সত্য তথ্য গ্রহণ করা মানে তাদের প্রচার-রাজনীতি দুর্বল হওয়া।
চতুর্থত, মৌলবাদীরা ভয় পায় মানবাধিকার শব্দটাকেই। মানবাধিকার মানে—রাষ্ট্র, সমাজ বা শক্তিধর গোষ্ঠী কাউকে নিপীড়ন করতে পারবে না। সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা মানে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এটি মৌলবাদীদের স্বার্থের পরিপন্থী—কারণ তারা যে কাঠামো তৈরি করতে চায়, সেখানে অন্যের অধিকার মানার কোনো জায়গা নেই। ফলে তারা প্রতিনিয়ত এই দাবিকে ‘ধর্মবিরোধী’, ‘সংস্কৃতিবিরোধী’ কিংবা ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
সবশেষে, মৌলবাদীদের ভয়ের বড় কারণ সামাজিক পরিবর্তনের শক্তি। পৃথিবী যত এগোচ্ছে, মানুষ ততই বুঝছে—ভালোবাসা, সম্পর্ক, পরিচয় এগুলো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্র, সংগঠন বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুমতি নিয়ে মানুষ নিজের পরিচয় বেছে নেয় না। সমাজে যখন এই উপলব্ধি বাড়ে, তখন মৌলবাদী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তাই তারা মরিয়া হয়ে পড়ে, চিৎকার করে, গালাগালি করে, ঘৃণা ছড়ায়।কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে—মানবাধিকারকে কখনো দমিয়ে রাখা যায় না।সমকামীদের অধিকার মানে কারও অধিকার কেটে নেওয়া নয়; বরং সমাজকে আরও মানবিক করা। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা, তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান প্রদর্শন করা। মৌলবাদীরা যত ভয়ই পাক, যত বিরোধিতাই করুক—ব্যক্তির স্বাধীনতা, ভালোবাসার অধিকার এবং নিরাপত্তার অধিকার একসময়ই প্রতিষ্ঠা পাবে। কারণ মানবতা সবসময় ঘৃণাকে পরাজিত করেছে; ভবিষ্যতেও করবে।