বহু ধারণা, অনেক ভ্রান্তি — মানুষ আর প্রেমের প্রশ্নে কেমন সহজে ভুলে যাই মানবিকতাকে। সব কথার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত—ইচ্ছা, সম্মান আর অধিকার। আপনি বললেন, “সমকামিতা কি তাদের অধিকার নয়? কেন তাদেরকে আমি হত্যা করবো? এটা তো আমার কাজ নয়।” এই সরল প্রশ্নগুলো থেকেই শুরু করা যাক — কারণ অনেক সময়ই কঠোর প্রতিক্রিয়ার পিছনে থাকে অজানা ভয়, ভুলধারণা বা সামাজিক প্রভাব। নিচে সেই ভাবনাগুলো তুলে ধরে একটি কলাম দিলাম।প্রেম, পরিচয় ও অধিকার: মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেমানুষের পরিচয় — সেটা তার লিঙ্গবোধ, যৌন আকর্ষণ বা প্রেম—সবটাই ব্যক্তিগত। কেউ কারো প্রতি প্রেম অনুভব করল, এটা তাদের অন্তরের সত্য। আমরা যদি পরীক্ষা করে দেখি, আইন ও মানবাধিকারবোধ যে পথে এগোচ্ছে, সেটা মূলত পরিচয় ও প্রেমকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ বলে মানে। সুতরাং “সমকামিতা” বা সমলিঙ্গের প্রেম কেবল ব্যক্তির জন্মগত বা আবেগগত বৈশিষ্ট্য—এটা কোনো অপরাধ নয়; বরং তারাও একই মানুষের ভাগ, একই আবেগ, একই ভালোবাসার অধিকার রাখে।ভয় ও বিদ্বেষের উৎসঅনেকেই সমকামিতা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ধারণ করে—ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, অথবা কল্পিত রোগ-রোগীদের ভীতি ইত্যাদি লেগে থাকে। কিন্তু যে সব কিছুর নাম ‘ভিন্নতা’, তা ভয়ের কারণ হতে পারে—আচরণ ভিন্ন হলে মানুষ ভয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সবচেয়ে সহজ পথ হলো জ্ঞান; জানলে ভয় কমে, সহমর্মিতা বাড়ে।আইন ও সামাজিক ন্যায়বিশ্বের অনেক দেশে—বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও—সমকামিতা অপরাধ নয়, বরং সমলিঙ্গ বিবাহ ও সুরক্ষা দিতে আইনগত স্বীকৃতি দিচ্ছে। আইন যখন মানবিকতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়, তখন সেটি সবাইকে অগ্রাহ্য করে না। আমাদের সমাজে যদি কেউ আলাদা থাকে, তাকে নির্যাতন করা, অপমান করা বা হত্যা করা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না—এটি নৈতিক ও বৈধভাবে দুটোই অগ্রাহ্যযোগ্য।স্বাস্থ্য ও মানবিক দিকসমকামিতা রোগ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এনেকে রোগের তালিকা থেকে বহু আগে সরিয়ে দিয়েছেন। বরং এমন লোকদের প্রতি সহানুভূতি বহুগুণ ভালো কাজ—তারা মানসিক এবং সামাজিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে; ঠিক সময়ে সমর্থন ও নিরাপদ পরিবেশ পেলে তারা সুস্থভাবে জীবন কাটাতে পারে। কঠোরতা বা সহিংসতা মানসিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে, মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।ধর্ম ও নৈতিকতা: আলোচনা, না চাপানধর্মীয় পাঠ ও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে; ধর্মই যদি কারো জীবনের পথপ্রদর্শক হয়, তবুও ধর্মের মূল শিক্ষা—অন্যের প্রতি দয়া, করুণা ও ন্যায়ের দাবি—সেটাই প্রধান হওয়া উচিত। ধর্মকে হাতিয়ার করে কারো অস্তিত্ব বা জীবনকে অবলুপ্ত করা কখনোই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ধর্মীয় নেতাদেরও দায়িত্ব মানবিক দিক দেখানো—ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সহিংসতা নয়, সংলাপই ভঙ্গুর দ্বার খোলে।সহনশীলতা নয়—সমতা চাইসহনশীলতা মানে অল্প সহ্য করা নয়; সেটি একচিলতেভাবে “তাদের সহ্য করছি”—না, আমরা চাই সমতা। অর্থাৎ, পুরস্কৃত বা গ্রহণযোগ্য করার দিকেই সমাজ এগোলে ভালো; সমান সম্মান, সমান অধিকার—চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা, আত্মরক্ষার অধিকার সবের জন্য সমান হওয়া চাই। যেখানে সমতা নেই, সেখানে অবিচার আছে—এটাই বদলানোর কথা।ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞা: প্রশ্ন থেকেই শুরুআপনি বলেছেন—“আমি কেন তাদেরকে হত্যা করবো? এটা তো আমার কাজ নয়।”—এই বক্তব্যটির মধ্যেই একটা বড় মানসিক পরিবর্তন লুকিয়ে আছে। বহু মানুষই প্রথমে শ্রমিক, প্রতিবেশী, বন্ধুর পাশে থেকে শুধু প্রশ্ন করে—“তোমরা কেন এভাবেইো?”—এই প্রশ্নই অনেক সময় ভাঙতে পারে অমানবিকতার দেয়াল। একটি সহজ পাঠ: ভয় করলে প্রশ্ন করো, ঘৃণা করলে চিন্তা করো, কিন্তু ক্ষতি করো না।শেষ কথা: আমরা কেমন সমাজ হতে চাই?একটি সভ্য সমাজের পরিচয় হলো—বিভিন্নতাকে গ্রহণ করা, দুর্বলকে রক্ষা করা, এবং সহানুভূতিকে মূল্যায়ন করা। যদি প্রেম ও পরিচয়কে অপরাধ করে দেখা হয়, আমরা তখনই অগ্রাহ্য করি মানবতার সেরা দিকগুলো। তাই চলুন—নির্যাতনের জায়গায় সংলাপ, ঘৃনার জায়গায় জানাশোনা এবং বিচারের জায়গায় মানবিকতা রাখি। নিজের দৈনন্দিন জীবনে ছোট্ট পদক্ষেপগুলো—কজনোকে বড় স্রোতে ঠেলে দেয়া থেকে বিরত থাকা, অশ্লীল কথার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এবং ভিন্নমতের মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসবই বড় পরিবর্তনের বিবর্ণ শুরু।আগে বলেছিলেন যে হত্যা আপনার কাজ নয়—ভালো কথা। তবু এগোতে হবে এক ধাপ সামনে: অন্যায় দেখলে চুপ থাকা নয়, কথা বলা; বিভ্রান্তি দেখলে শিক্ষা দেওয়া; সহিংসতার মুখে দাঁড়ানো—মানবতার জয় নিশ্চিত করার ছোট কিন্তু মর্মস্পর্শী কাজগুলো আমাদের সকলের।