আমার বোন সাদিয়া বেগমকে হত্যা করেছে মৌলবাদীরা – আমি বিচারের দাবি জানাই

আমার বোন সাদিয়া বেগমকে হত্যা করেছে মৌলবাদীরা – আমি বিচারের দাবি জানাই

আমি একজন সাধারণ মানুষ। ভাংঘুরা উপজেলার কুমিল্লা জেলার অধিবাসী। আমি লিখি—লিখি কারণ সমাজের অন্যায়, অন্ধত্ব, এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ আছে। আমার ব্লগে আমি হিজবুত তাহরির, হেফাজতে ইসলাম, দেওয়ানবাগি ও অন্যান্য উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছি। কিন্তু আমার সেই লেখার প্রতিশোধ নেওয়া হলো আমার বড় বোন সাদিয়া বেগমকে হত্যা করে।

আমার বোনের অপরাধ কী ছিল? সে কি অপরাধ করেছিল? না। সে কেবল সংস্কৃতিকে ভালোবাসত। শিশুদের নাচ শেখাত। সাহসের সাথে সমাজে আলো ছড়াতে চাইত। কিন্তু সেই সাহসই সহ্য করতে পারেনি এই সময়ের অন্ধকার মৌলবাদীরা।

এ ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি—মোল্লা সিকদার আমিন নামের এক মৌলবাদী নেতা, যিনি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে হিজবুত তাহরির ও উগ্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত। তিনিই আমার লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নিরপরাধ বোনকে টার্গেট করার নির্দেশ দেন।

সাদিয়া বেগম: এক সাহসী সংস্কৃতি সৈনিক

আমার বোন সাদিয়া বেগম (৩০) ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা নারী। আমাদের এলাকায় একটি নাচের স্কুল চালাতেন। শিশুদের নৃত্য শেখাতেন, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবসের মতো উৎসব আয়োজনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতি মানুষকে মুক্ত করে, আর মৌলবাদ মানুষকে বন্দী করে।

এই বিশ্বাসই তাকে টার্গেটে পরিণত করে। মৌলবাদীরা চায়নি সমাজে এমন কোনো নারী থাকুক, যে শিশুদের হাতে সংস্কৃতির পতাকা তুলে দেয়।

ধাপে ধাপে হত্যার পরিকল্পনা

প্রথম হামলা – ৯ নভেম্বর ২০২৪

নাচের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে ৩ জন মুখোশধারী তাকে রাস্তায় আক্রমণ করে। লাঠি দিয়ে মাথা, পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, কিন্তু সাদিয়া থেমে যাননি।

দ্বিতীয় হামলা – ১৭ নভেম্বর ২০২৪

এইবার আরও ভয়ংকর। মোটরসাইকেলে করে এসে সাদিয়ার গায়ে এসিড ছুড়ে মারা হয়। তার গলা, কাঁধ ও বুকের অংশ মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়। আমরা থানায় যাই, কিন্তু পুলিশ বলে:
“নাচের মেয়ে রাতে ঘুরে বেড়ালে এসব তো হবেই।”
আমরা বুঝি—শুধু মৌলবাদ নয়, প্রশাসনও নীরব সহযোগী।

চূড়ান্ত হামলা – ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

স্কুল থেকে ফেরার পথে রড ও লাঠি নিয়ে তার উপর হামলা করা হয়। মাথায় গুরুতর আঘাতের ফলে হাসপাতালে নেয়া হয়। আইসিইউতে ১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৫ ডিসেম্বর সকালবেলা সে মৃত্যুবরণ করে।

এই পুরো ঘটনাটি পরিকল্পিত। এবং আমরা তথ্যপ্রমাণসহ নিশ্চিত হয়েছি—মোল্লা সিকদার আমিনই এই হামলাগুলোর মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা। তার নেতৃত্বে একটি চক্র এই হামলা সংঘটিত করে।

বিচার চাই, প্রতিশোধ নয় – কিন্তু ন্যায়বিচার চাই

যখন আমরা থানায় মামলা করতে যাই, তখনও পুলিশ প্রমাণ চায়। বলে “এটা দুর্ঘটনা হতে পারে।” কিন্তু আমাদের পরিবার থামেনি। আমরা কোর্টে মামলা দায়ের করি। আদালতের নির্দেশে অবশেষে মামলা রুজু হয়।

তবু এখনও অনেক কিছুই ঝুলে আছে। এখনও মোল্লা সিকদার আমিন গোপনে প্রভাব বিস্তার করছে। সে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমার বোনের রক্ত মাটিতে শুকিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রশ্ন রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে, আপনার কাছে

একজন সংস্কৃতিপ্রেমী নারী কি এই দেশে নিরাপদ নয়?

যারা শিশুদের গান-নাচ শেখায়, তারা কি ‘অপরাধী’?

আমরা যারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলি, আমাদের পরিবার কেন ঝুঁকিতে থাকবে?

আমি চাই, আমার বোন সাদিয়া বেগমের হত্যাকারীরা আইনের আওতায় আসুক।
আমি চাই, মোল্লা সিকদার আমিন ও তার গোষ্ঠীকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার করা হোক।
আমি চাই, বাংলাদেশে সংস্কৃতির চর্চা নিরাপদ হোক।

সাদিয়া, তুমি আলো ছিলে – তোমার আলো নিভে যায়নি।
তোমার রক্ত আমাদের কলমে রঙ হয়ে থাকবে। আমরা লিখে যাবো, লড়বো—তোমার জন্য, এই সমাজের জন্য।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *