একটি ন্যাপকিনের অপরাধ
সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ। কুমিল্লার ভাংগুরা বাজারের হাটের দিন। বাজারের ভেতর থেকে চায়ের দোকানের ধোঁয়া, বাস-সিএনজির শব্দ, আর কলেজগামী কিছু তরুণ-তরুণীর ব্যস্ততা মিলেমিশে ছিল প্রতিদিনকার চেনা ছন্দে। কিন্তু সেই চেনা সকালটাকে আচমকা থমকে দিল একটি স্বাস্থ্যপণ্যের নাম— একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন।
অর্পিতা সাহা, স্থানীয় ভাংগুরা মহিলা কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী, সেদিন সকালে কলেজে যাবার আগে ভাংগুরা বাজারের ‘জননী মেডিকেল হল’ নামক একটি ফার্মেসিতে ঢুকেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল খুব সাধারণ— মাসিকের জন্য একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা। কিন্তু এই সামান্য কাজটিই তাকে করে তুলল মৌলবাদি চোখে এক ‘অপরাধী’।
ফার্মেসির সামনের মসজিদের চত্বরেই চলছিল এক তথাকথিত ‘ধর্মীয় বয়ান’। মাইকিং করছিল হিজবুত তাহরির, হেফাজতে ইসলাম ও দেওয়ানবাগি গোষ্ঠির স্থানীয় নেতারা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন berüchtigt মৌলবাদি বক্তা মোল্লা সিকদার আমিন। তিনি হাটের দিনগুলিতে প্রায়ই জনসমক্ষে ‘নৈতিকতা রক্ষা’ নামের আড়ালে নারীবিদ্বেষ প্রচার করে থাকেন।
সেদিনও মাইক হাতে দাঁড়িয়ে বলছিলেন তিনি,
> “এই বাজারে মেয়েরা এখন এমন পাপের জিনিস কিনছে যা ঘরে রাখাও হারাম! স্যানিটারি ন্যাপকিন তো অপবিত্র জিনিস! একজন নারী কীভাবে প্রকাশ্যে এগুলো কিনতে পারে? এসব ইসলামবিরোধী কাজ বন্ধ করতে হবে!”
লোকজন জড়ো হতে লাগল। ফার্মেসির সামনের পথ আটকে দাঁড়াল কয়েকজন উগ্র অনুসারী। অর্পিতাকে ঘিরে শুরু হলো ফিসফাস, কেউ কেউ ভিডিও করতে লাগল, কেউবা সরাসরি বলল,
> “তুই কি মুসলমানদের বাজারে এসব অশ্লীল জিনিস কিনতে আসছিস?”
অর্পিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে ৭০ টাকার একটি ন্যাপকিনের প্যাকেট। চোখে জল, গলায় কাঁপা স্বর। অথচ সে কোনো অন্যায় করেনি। সে চুপচাপ পণ্যটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু মৌলবাদিরা ততক্ষণে মাইকে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে—
> “আমরা ফতোয়া দিচ্ছি— এই ভাংগুরা বাজারে আর কোনো ফার্মেসি এসব হারাম জিনিস বিক্রি করতে পারবে না। যারা বিক্রি করবে, তাদের বয়কট করা হবে।”
—
ফতোয়ার সেই ঘোষণার পর বাজারের অন্তত ৪টি ফার্মেসি স্যানিটারি প্যাড বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ আবার কালো পলিথিনে ঢেকে বিক্রি করছে, যেন তা কোনো চোরাই বা নিষিদ্ধ দ্রব্য। দোকানিরাও আতঙ্কিত, কারণ মৌলবাদিদের হুমকি মানে স্থানীয় সহিংসতার সম্ভাবনা।
অথচ এটাই সেই দেশ, যেখানে সরকারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। যেখানে টিভিতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন চলে। সেখানে একটি প্যাড কেনাকে যদি ‘অপরাধ’ বানানো হয়, তাহলে এই সমাজ আসলে কোন পথে যাচ্ছে?
—
আমরা ভুলে যাচ্ছি, একজন নারীর মাসিক কোনো গোপনীয়তা বা লজ্জার বিষয় নয়। এটি একেবারেই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিক চক্র, যা স্বাস্থ্যসচেতনভাবে পরিচালনা করাই সভ্যতার চিহ্ন। বরং সেই চিন্তাধারাই বিপজ্জনক, যা একজন কিশোরী মেয়েকে তার প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে জনসমক্ষে অপমানিত করে।
অর্পিতা সাহার অপরাধ ছিল কী?
একটি ন্যাপকিন কেনা?
নাকি মৌলবাদের চোখে নারী হয়ে বেঁচে থাকা?
ভাংগুরা বাজারে একটি ন্যাপকিনের জন্য একটি মেয়ে কাঁদে— এ দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না।
ভাংগুরা বাজারের সেই দিনটার পর কুমিল্লার অর্পিতা সাহা আর কোনোদিন প্রকাশ্যে ফার্মেসিতে যাননি। এমনকি কলেজেও গিয়েছেন অনিয়মিতভাবে। তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক রকম অদৃশ্য ভয়, যা শুধু একজন নারীর শরীর না, তার আত্মমর্যাদাকেও কুরে কুরে খায়।
সেই বিকেলে বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে তিনি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। কারণ তার মা, যিনি একজন স্কুলশিক্ষিকা, তিনিও ভয়ে বলেছিলেন,
> “এই সমাজে বেশি কথা বলিস না মা। আজ তোর ছবি ভাইরাল হলে কাল ঘরে আগুন দিতে পারে।”
মায়ের সেই ভয়ের পেছনে যুক্তি আছে। ভাংগুরা বাজারে যারা সেদিন ফতোয়া দিয়েছিল, তারা কেবল কথার মানুষ নয়। মোল্লা সিকদার আমিন, হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরির এবং দেওয়ানবাগি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বহুবার বাজারে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। মেয়েদের ওড়না পরার ধরন নিয়েও তারা ‘তাবলিগি আদব’ চাপিয়ে দিয়েছে। যে কেউ ভিন্ন মত দিলে সে ‘ইমানহারা’, ‘নাস্তিক’, ‘গোলামী পশ্চিমাদের’।
এমন একটা পরিস্থিতে অর্পিতা বুঝে গেছে— এই সমাজে নারী হয়ে বাঁচার জন্য তাকে শুধু শরীর নয়, আত্মাও লুকিয়ে রাখতে হয়।
—
পরের দিন কলেজে গেলে তার কিছু বান্ধবী বলেছিল,
> “আমরা তো প্যাড কিনি ভাইয়ের হাত দিয়ে।”
“তুই এভাবে ফার্মেসিতে গিয়ে কিনেছিস, সাহস দেখাস! সমাজ তো ছাড়বে না।”
কেউ কেউ আবার ভিডিওটা দেখে মজা করেছে। অথচ কেউ প্রশ্ন করেনি— কেন একজন মেয়েকে নিজের মৌলিক স্বাস্থ্যপণ্য কিনতে গিয়ে সমাজের বিচার শুনতে হয়?
এভাবেই মৌলবাদ কেবল ফতোয়া দেয় না, সে চুপ করিয়ে দেয় চারপাশ। মেয়েদের মুখ বন্ধ করে রাখে, যাতে তারা প্রশ্ন না তোলে। যাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে লজ্জা, অপরাধবোধ, এবং আত্মগ্লানিতে।
অর্পিতা সাহা ভাংগুরা বাজারে ‘ন্যাপকিন কান্ড’-এর পর নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজ তো গুটিয়ে থাকে না— বিশেষ করে যখন কেউ মৌলবাদের মুখে প্রশ্ন তুলে দাঁড়ায়।
১. পরিবারকে মৌলবাদিদের হুমকি
ঘটনার দুই দিন পরেই সন্ধ্যার দিকে অর্পিতার বাবা— একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা— বাজারে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, পরিচিত কয়েকজন দোকানদার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তার পরিচিত মুদি দোকানদার সরাসরি বলে দিল,
> “স্যার, কিছু মনে কইরেন না, আপনের মাইয়া যে ফার্মেসির সামনে ওইরকম করল, মোল্লা সিকদার আমিন তারে নাস্তিক বলেছে। বাজারে গন্ডগোল হলে আমরা কী করমু?”
রাতে কয়েকজন চেহারায় চাপা দাড়িওয়ালা লোক এসে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিল,
> “আপনের মাইয়ারে থামান। এহনই যদি শিখান না, পরে কিন্তু মুখে ঘাম নাই। এই বাজারে আমরা ইসলাম রক্ষা করবই।”
মোল্লা সিকদার আমিনের অনুসারীরা তাদের এলাকায় অঘোষিত একরকম শাসন কায়েম করেছে। পাঞ্জাবি পরা, টুপি-পড়া কিছু ‘ভয়’ যখন গলি দিয়ে হেঁটে যায়, তখন জানালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
অর্পিতার মা বলেছিলেন,
> “মেয়ে মানুষ বইলা মুখ খুইলা কথা বলব না, তা যদি শিখাই না, তাইলে আমাদের জীবনও শান্তি না।”
—
২. প্রশাসনের নীরবতা
ঘটনার পর এলাকার কয়েকজন তরুণ অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল। তারা বলেছিল, মাইকিং করে ফার্মেসিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, এক মেয়েকে জনসমক্ষে অপমান করা হয়েছে— এটা তো আইনবিরুদ্ধ।
চেয়ারম্যানের উত্তর ছিল স্পষ্ট,
> “এইসব ধর্মের ব্যাপারে আমরা কিছু বলি না। ওদের কথা না শুনলে এলাকায় ফেড়া ওঠে।”
থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েও হুমকি পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। পুলিশ এক হাত তুলে বলেছে,
> “এরা বড় গ্রুপ। আপনি কি চান আপনার মেয়ের নামে পর্ণ ভিডিও বানায় দিয়ে ভাইরাল করে দেয়? শান্ত থাকেন। এইসব বিষয় এভয়েড করতে হয়।”
অর্থাৎ, রাষ্ট্র যে সুরক্ষা দিতে পারত, সে-ও নীরব দর্শক। ফলে মৌলবাদি গোষ্ঠিগুলো হয়ে উঠেছে অঘোষিত আদালত, বিচারক, আর শাস্তিদানকারী।
—
৩. পাড়া-মহল্লার চাপ
অর্পিতাদের বাসা থেকে খুব দূরে নয় ‘বড় মসজিদ’। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন এলাকার প্রভাবশালী পরিবারগুলো। ঘটনার পর সেই মসজিদের এক মহিলা পর্দানশিন দল এসে সরাসরি বলেছিল,
> “আপনের মাইয়া কলেজে পড়ে ঠিক আছে, কিন্তু ওর মাথায় বুঝ নাই। আমরা চাই ও বাড়ির বাইরে কম বের হয়।”
এমনকি তার এক বন্ধুর মা এসে বললেন,
> “আমার মেয়েরে এখন থেকে আর তোমার মেয়ের সাথে পাঠাব না। আজকে ন্যাপকিন, কালকে নারীবাদের নামে উল্টা পাল্টা করবে।”
পাড়া-মহল্লার অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হলো ধীরে ধীরে। আগে যে প্রতিবেশীরা হাসিমুখে ‘কী খবর’ বলত, তারা যেন ভুলে গেল অর্পিতা একজন সাধারণ, ভদ্র, মেধাবী মেয়ে।
—
এই সমাজে এক নারীর সাহসী পদক্ষেপ যে কতোটা একাকী করে তোলে, তার বাস্তবচিত্র হয়ে দাঁড়াল অর্পিতা। মৌলবাদ, প্রশাসনের নীরবতা, আর সামাজিক চাপ মিলে তাকে এক নীরব কারাগারে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—
এই চাপের কাছে কি সে হার মানবে?
নাকি একদিন এই সমাজের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলবে—
“আমার শরীর, আমার প্রয়োজন, আমার অধিকার— অপরাধ নয়।”