অপবিত্র নয়, অপমানিত নারী যখন ‘ঘরের কয়েদি’

অপবিত্র নয়, অপমানিত

🩸 নারী যখন ‘ঘরের কয়েদি’

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ভাংঘুরা বাজার এলাকাসহ আশেপাশের বহু গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় আজও মেয়েদের মাসিক চলাকালীন সময়ে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়। যেন তারা মানুষ নয়, যেন তারা সমাজের জন্য অশুভ, অপবিত্র কিছু।

এই মধ্যযুগীয় বর্বর চর্চার নেতৃত্বে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরির, দেওয়ানবাগি মতবাদে বিশ্বাসী কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং তাদের আঞ্চলিক ‘ধর্মীয় নেতা’ মোল্লা সিকদার আমিন।

তাদের ফতোয়া স্পষ্ট—

> “মাসিক চলাকালীন নারী ঘর থেকে বের হতে পারবে না। সে এই সময়ে রান্নাঘর, বসার ঘর, বারান্দা, এমনকি পরিবারের খাবারের জায়গায়ও বসতে পারবে না। তাকে আলাদা ঘরে একা থাকতে হবে।”

তাদের ভাষায়, “এই সময় নারী অপবিত্র”— অথচ আসলে অপবিত্র নয় নারী, অপবিত্র এই চিন্তা, এই দৃষ্টিভঙ্গি।

🚪 কেবল দরজা নয়, বন্ধ করে দেওয়া হয় সম্ভাবনার জানালা

একটি কিশোরী যখন প্রথম মাসিক শুরু করে, তখন তার চারপাশে থাকা প্রাপ্তবয়স্কদের দায়িত্ব হলো তাকে স্বাস্থ্যজ্ঞান দেওয়া, সাহস দেওয়া, সহযোগিতা করা। কিন্তু বাস্তবে কী হয়?

এলাকায় বহু পরিবারে আজও দেখা যায়—

মাসিক শুরু হলে মেয়েকে আলাদা বিছানায় দেওয়া হয়।

রান্না ঘরে যেতে দেওয়া হয় না।

মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়।

ভাই-বাবা বা কোনো পুরুষ সদস্যের সামনে আসতে দেওয়া হয় না।

খাবার দিতে হয় কাগজের থালায়, যেন সে ‘স্পর্শ’ না করে।

তার গায়ে অন্য কেউ হাত দিলেও মনে করা হয় সে ‘অপবিত্র’ হয়ে গেছে।

এই সময়ে তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না, খেলতে পারা তো দূরের কথা—মনে করিয়ে দেওয়া হয়,

> “তুই এখন একটা পাপের শরীর!”

এই অবস্থান কেবল শারীরিক নয়, এক ভয়াবহ মানসিক বন্দিত্বও বটে।

🧬 প্রকৃতি কি অপবিত্র?

প্রশ্ন হলো—একটি প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়া কীভাবে অপবিত্র হয়?
মাসিক (menstruation) হলো জরায়ুর আবরণ নিঃসরণের একটি প্রক্রিয়া, যা প্রত্যেক সুস্থ নারীর জীবনের অংশ। এটি এমন একটি জৈবিক ঘটনা, যার মাধ্যমে মানবজাতি টিকে আছে।

তাহলে কেন এই প্রাকৃতিক বিষয়কে ঘৃণার, গ্লানির, নিষেধের বিষয়ে পরিণত করা হচ্ছে?

উত্তর সোজা—অজ্ঞতা, ভয়ের রাজনীতি, এবং নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার এক অপচেষ্টা।

🧠 ফতোয়া নয়, বিজ্ঞান যা বলে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউনিসেফ (UNICEF), এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়—সবাই মাসিককালীন সময়ে নারীর বিশেষ যত্ন ও সম্মান বজায় রাখার কথা বলে। কারণ এই সময় শারীরিকভাবে একটু দুর্বলতা, হরমোনগত পরিবর্তন, এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়।

এসময় দরকার—

বিশ্রাম

স্বাস্থ্যকর খাবার

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ

মানসিক সাপোর্ট

হাইজিন পণ্য (যেমন স্যানিটারি ন্যাপকিন)

কিন্তু যেটা দরকার ছিল সহানুভূতি, সেখানে তারা দিয়েছে ঘৃণা।
যেখানে দরকার ছিল আলাদা যত্ন, সেখানে দিয়েছে আলাদা ঘর।

🔥 নারীর শরীর মানে ‘লজ্জা’?

এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর যুক্তি হলো—নারীর মাসিক “লজ্জাজনক”, “লুকানোর মতো”, “গোপন” বিষয়। অথচ তারা নিজেরাই সেটিকে প্রকাশ্য আলোচনা করে ফতোয়া জারি করছে, ঘৃণা ছড়াচ্ছে।

তাদের চোখে নারীর শরীর মানে শুধুই ‘পাপ’—

তার স্তন লজ্জার বিষয়

তার ঋতুস্রাব পাপের বিষয়

তার গর্ভধারণ আল্লাহর রহমত, কিন্তু সে গর্ভধারণের প্রক্রিয়া যেন ‘হারাম’

এই দ্বিচারিতা শুধু ধর্মের অপব্যবহার নয়, এটি নারীর অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা।

✊ প্রতিবাদ আমার অধিকার, কলম আমার অস্ত্র

এই লেখার মাধ্যমে আমি বলতে চাই—
নারীর মাসিক কোনো ‘অপরাধ’ নয়। এটি একটি অধিকার, একটি সম্মানযোগ্য শারীরিক সত্য।

ঘরে বন্দি করে রাখার মানসিকতা, স্যাংশন বা ফতোয়া আসলে নারীর সম্ভাবনাকে দমন করার চেষ্টা। যে সমাজ মাসিককালীন নারীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, সে সমাজ নিজেই অন্ধকারে বসবাস করে।

আমার ব্লগে ধারাবাহিক প্রতিবাদ লেখার এই দ্বিতীয় পর্বে আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই—
নারী অপবিত্র নয়, বরং সমাজ তাকে অপমান করছে।

🗣️ প্রশ্ন আমাদের সবার জন্য:

আপনি কী মাসিককালীন সময়ে আপনার মেয়েকে আলাদা করে রাখেন?

আপনি কী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেন, “তুমি পবিত্র, তুমি স্বাভাবিক, তুমি মানুষ”?

আপনি কী সাহস করবেন মেয়েকে বলতে—“তোমার শরীর তোমার অধিকার”?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়াই আজ জরুরি।

🔚 শেষ কথা

ঘরে বন্দি করে রেখে এক কিশোরীকে যদি বোঝানো হয় সে ‘নোংরা’—তাহলে পুরো সমাজটাই নোংরা হয়ে যায়।
একজন মা, বোন বা মেয়ে—যদি এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় অপমানিত হয়, তাহলে আমরা কিসের সভ্যতা গড়ছি?

সময় এসেছে ঘরের দরজা খুলে দেওয়ার।
সময় এসেছে বলার—

> “তুমি অপবিত্র নও, তুমি অপমানিত হয়েছো। কিন্তু আমরা লড়বো, যাতে কেউ আর তোমাকে অপমান না করতে পারে।”

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *