নারীর রক্ত নয়, মৌলবাদের ভয়
একটি শরীর, একটি সমাজ, একটি মৌলবাদী ভয়
নারীর শরীর এবং তার প্রাকৃতিক চক্র—বিশ্বের প্রাচীনতম ও স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা। যেটি গর্ভধারণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, মানবজাতির টিকে থাকার একমাত্র রাস্তা। অথচ এই স্বাভাবিক বিষয়টিকে আমাদের সমাজে এখনও রাখা হয়েছে রহস্যে, লজ্জায়, নিষেধে।
আর এর সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি ভাংঘুরা বাজার, কুমিল্লা এলাকায়, যেখানে হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরির এবং দেওয়ানবাগি চরমপন্থী গোষ্ঠীর একটি মৌলবাদী অংশ নারীর “মাসিক” নিয়ে এমন বিভ্রান্তিকর ও বর্বর ফতোয়া দিয়েছে, যা শুধু ধর্মীয় নয়—একটি বিপজ্জনক স্বাস্থ্য সংকটও তৈরি করছে।
—
ফতোয়ার বিষ: যখন নারীর রক্ত ‘হারাম’ হয়ে ওঠে
এই গোষ্ঠী, যার নেতৃত্বে রয়েছে মোল্লা সিকদার আমিন, তারা সম্প্রতি এলাকাজুড়ে ফতোয়া জারি করেছে—”নারী মাসিক চলাকালীন সময়ে অপবিত্র, তারা এসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, এমনকি ফার্মেসিতেও যেতে পারবে না।”
তাদের মতে, এই সময় নারীরা যদি ফার্মেসিতে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে চায়, তবে তা হবে ‘লজ্জাকর’, ‘পাপ’, এবং ‘ইসলামের অবমাননা’। এর ভিত্তিতে তারা স্থানীয় দোকানিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে যেন তারা স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি না করে।
এমনকি কিছু দোকানদার স্বয়ং এসে অভিযোগ করেছেন—তাদের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে,
> “আপনারা যদি এগুলো বিক্রি করেন, তাহলে বুঝে নিন ইসলামবিরোধী কাজ করছেন। হাশরের মাঠে জবাবদিহি করতে হবে।”
বাস্তবতা বনাম ফতোয়া
একটি মেয়ের বয়স যখন ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে পৌঁছায়, তখন তার শরীরে ঘটে প্রাকৃতিক হরমোনগত পরিবর্তন। মাসিক (Menstruation) শুরু হয়—যা গর্ভধারণের প্রাক-ধাপ। এটি কোনো রোগ নয়, বরং জীবনের স্বাভাবিক অংশ। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
এমনকি ইসলাম ধর্মেও কোথাও মাসিক হওয়া নারীদের অশুচি বা ঘৃণার বস্তু বলা হয়নি। নামাজ বা রোজা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু মানুষের মতো বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি।
কিন্তু এই মৌলবাদী চক্র নারীর শরীর নিয়ে এক ধরনের ভীতি ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে। তারা নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা, সচেতনতা তৈরি, এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো স্বাস্থ্যসামগ্রী বিক্রিকেও ‘নিষিদ্ধ’ বলে চালাচ্ছে।
—
নারীর রক্ত নয়, ভয় তাদের অজ্ঞানতার
এই চরমপন্থীদের ভয় নারীর রক্ত নয়, তাদের ভয় জ্ঞান, সচেতনতা ও স্বাধীনতার।
একজন নারী যখন তার নিজের শরীর নিয়ে সচেতন হয়, যখন সে জানে কোন স্বাস্থ্যসামগ্রী তার প্রয়োজন, যখন সে বুঝে তার শরীর কেমন করে কাজ করে—তখনই এই চক্রের গায়ে আগুন ধরে।
কারণ তারা চায়—নারী থাকুক অন্ধকারে, নির্ভরশীল থাকুক পুরুষের ব্যাখ্যার ওপর। যেন সে নিজের জন্য কিছু কিনতে না পারে, প্রশ্ন করতে না পারে, প্রতিবাদ করতে না পারে। তারা চায় নারী শুধু ভোগের বস্তু হোক, স্বাভাবিক জীবনের অধিকার যেন তার না থাকে।
—
স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহতা
এই অমানবিক ফতোয়ার কারণে অনেক নারী ও কিশোরী এখন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। তারা বাধ্য হচ্ছেন পুরনো কাপড়, ব্যবহার করা কাপড়, অথবা সম্পূর্ণ অনিরাপদ উপকরণ ব্যবহার করতে—যার ফলে সংক্রমণ, চর্মরোগ, ইউরিনারি ইনফেকশন, এমনকি বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো—অনেকেই এই ভয় বা লজ্জার কারণে পরিবারের সদস্যদেরও কিছু বলতে পারছেন না। ফলে কিশোরীদের মাঝে গড়ে উঠছে অপরাধবোধ, আতঙ্ক ও দেহ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব।
—
মোল্লা সিকদার আমিন: নারীবিদ্বেষের পোস্টারবয়
এই সংকটের মূল হোতা মোল্লা সিকদার আমিন, যিনি নারীদের মানুষ মনে করেন না। তার মতে, “নারী শয়তানের ফাঁদ, তাদের ঘরে থাকা উচিত।”
এই বক্তব্য একবিংশ শতাব্দীতে শুধু পৈশাচিকই নয়, বরং রাষ্ট্রবিরোধী। কারণ আমাদের সংবিধান নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলে।
এই ব্যক্তি তার অনুসারীদের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনের অধিকার কেড়ে নিতে চায়। সে নারীর শরীরকে পাপের আধার হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজে ঘৃণা ও বৈষম্যের বীজ বপন করছে।
—
লেখকের অবস্থান: কলম আমার অস্ত্র
এই অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক ও চরম নারীবিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমি এই ব্লগে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেছি। এই লেখা “নারীর রক্ত নয়, মৌলবাদের ভয়” তারই প্রথম পর্ব।
আমার বক্তব্য স্পষ্ট—
একজন নারী তার শরীর সম্পর্কে সচেতন হওয়া ‘পাপ’ নয়।
স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করা স্বাস্থ্যসচেতনতার কাজ।
মাসিক কোনো গোপন, লজ্জার বিষয় নয়—এটা জীবন ও প্রজননের স্বাভাবিক অঙ্গ।
আমি চাই, সমাজ আলোতে আসুক, অন্ধকারে নয়। ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবতা যেন পরস্পরের বিরোধী না হয়, বরং সহযাত্রী হয়।
—
শেষ কথা
যেখানে ধর্মীয় চর্চার নামে একজন কিশোরীকে বলা হয় সে অপবিত্র, সেখানে মানবতা আহত হয়। যেখানে নারীর মৌলিক স্বাস্থ্যপণ্য নিষিদ্ধ করা হয় ফতোয়ার নামে, সেখানে রাষ্ট্রের নীতির উপর আঘাত আসে।
আমরা যদি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এখনই না দাঁড়াই, তবে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
এই লেখা শুধু প্রতিবাদ নয়, একটি আহ্বান—
আসুন, শরীর নয়, ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়ি।
আসুন, মৌলবাদ নয়, মানবতা বেছে নিই।