সহনশীলতার ছায়া কেটে গেল: এক শতবর্ষী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মৌলবাদী আগ্রাসনের নির্মম দলিল

 একটি গাছ, একটি বিশ্বাস, এক শতাব্দীর সহাবস্থান

ভাংঘুরা বাজার, কুমিল্লা—এলাকার এক প্রাচীন মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটি শতবর্ষী গাছ—কেবল একটি গাছ নয়, বরং একটি বিশ্বাস, একটি সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের জীবন্ত প্রতীক। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই গাছটিকে বহু বছর ধরে উপাসনার একটি অবলম্বন হিসেবে দেখে আসছিলেন। প্রতিদিন না হলেও বিশেষ পূজা, উপবাস, বর্ষবরণ, কিংবা পারিবারিক সংকল্পে মানুষ এখানে প্রদীপ জ্বালাতো, জল ঢালতো, সিঁদুর পরাতো।

এই গাছটি ছিল এমন এক স্পেস যেখানে ধর্মীয় আচরণ নিরবিচারে পরিচালিত হতো, কিন্তু কখনও তা কারও বিরক্তির কারণ হতো না। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ—সকলের মাঝে ছিল এক ধরনের মূক বোঝাপড়া, যেটা বাংলার হাজার বছরের সমন্বিত সংস্কৃতির পরিচায়ক।

 ফতোয়ার আগুন: এক ষড়যন্ত্রের সূচনা

কিন্তু এই সহনশীলতার ছায়া দীর্ঘদিন টিকলো না।
২০২৪ সালের জুন মাসে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও উগ্রতা ছড়ানো এক চক্র—যার নেতৃত্বে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরির, দেওয়ানবাগি গোষ্ঠীর কিছু মৌলবাদী উপদল—তারা ভাংঘুরা বাজার, কুমিল্লা এলাকায় এই গাছটিকে ‘শিরক ও কুফর’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে স্থানীয়ভাবে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে।

এই মৌলবাদী প্রচারণার মূল হোতা ছিলেন এক প্রভাবশালী স্থানীয় ধর্মব্যবসায়ী—মোল্লা সিকদার আমিন। তিনি জনসম্মুখে ও মসজিদের খুতবায় ঘোষণা দেন:

> “এই গাছে পূজা হয়, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক। এই গাছ থাকবে না। হিন্দুরা এই গাছ দিয়ে পূজা করতে পারবে না। ইসলাম এইসব বেদাত বরদাশত করবে না।”

এই বক্তব্য শুধু একটি ফতোয়া নয়, বরং একটি পরিকল্পিত, ভয়ঙ্কর সংকেত ছিল—একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার, সহাবস্থানকে ধ্বংস করার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও চর্চাকে ‘হারাম’ ঘোষণার মাধ্যমে তাদের অস্তিত্বকেই সংকুচিত করার।

 ধ্বংসযজ্ঞ: যখন প্রতিবাদ আগুনে পরিণত হয়

হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানায়। তারা বলেন, “আমরা কারো ক্ষতি করছি না, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। আমাদের পূজা এই গাছেই হয় যুগ যুগ ধরে। আমরা এটিকে কেটে ফেলতে দেব না।”

কিন্তু সেই প্রতিবাদই হয়ে ওঠে চরম পরিণতির কারণ।

এক রাতে, ২০২৪ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে, ভাংঘুরা বাজার, কুমিল্লা এলাকায় হিন্দুদের দোকান, ঘরবাড়ি, এবং উপাসনাস্থলে হামলা চালানো হয়। আগুন দেওয়া হয় কয়েকটি দোকানে। কয়েকটি বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে ফেলা হয়। হিন্দু পরিবারের শিশু ও নারীদের ওপর ভয়ভীতি ছড়ানো হয়। কিছু পরিবার এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

এই হামলাগুলো ছিল পূর্বপরিকল্পিত, সংঘবদ্ধ এবং প্রশাসনের নীরবতায় উজ্জীবিত। কোনো দায় স্বীকার নেই, কোনো দোষারোপ নেই, বরং উল্টোভাবে দায়ী করা হয় হিন্দুদের “উস্কানিমূলক আচরণ” কে। যেন নিজের ঘরে পূজা করাও এক প্রকার অপরাধ!

 মোল্লা সিকদার আমিন: ধর্মের মুখোশে রাজনীতির খেলা

এই মৌলবাদী সহিংসতার পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কেবল একজন ধর্ম প্রচারক নন। মোল্লা সিকদার আমিন একজন ক্ষমতা-লোভী ব্যক্তি, যিনি ধর্মের নামে একটি কৌশলগত সন্ত্রাস ছড়ান। তিনি লোকদেখানো ধার্মিকতা, রাজনৈতিক যোগাযোগ, এবং ‘ইসলামের রক্ষক’ সাজার ছদ্মবেশে এলাকায় আধিপত্য কায়েম করেছেন।

তার বিরুদ্ধে বহুবার অভিযোগ উঠেছে—নারী নির্যাতন, ধর্মের নামে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, এমনকি সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে সম্পত্তি দখলের চেষ্টাও। কিন্তু প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক শক্তির আশীর্বাদ ও জনসাধারণের ভয় তাকে দিনকে দিন আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।

 প্রতিবাদ আমার দায়িত্ব: কলমে আমার প্রতিবাদ

আমি, আব্দুর রহিম—একজন নাগরিক, একজন লেখক হিসেবে দায়বদ্ধবোধ করি। তাই এই ঘটনার পর আমি আমার ব্লগে এই লেখাটি প্রকাশ করি। এর শিরোনাম দিই: “সহনশীলতার ছায়া কেটে গেল”—কারণ সত্যিই, এই ঘটনার পর আমাদের সমাজের সহনশীলতার ছায়া যেন কোথাও নেই।

আমি আমার লেখায় সরাসরি মোল্লা সিকদার আমিন ও তার মৌলবাদী চক্রকে চিহ্নিত করি। আমি যুক্তি, তথ্য এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দেখাই—কীভাবে ধর্মের নামে নিরীহ মানুষকে ভয় দেখিয়ে সমাজে অস্থিরতা ছড়ানো হয়। কীভাবে একটি বিশ্বাস, একটি গাছ, একটি পূজা—হঠাৎ করেই হয়ে ওঠে বিদ্বেষের কারণ।

আমার লেখার উদ্দেশ্য কারো ধর্মে আঘাত নয়, বরং ধর্মের নামে যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, হত্যা করে, তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া।

আমাদের করণীয়: মৌলবাদ নয়, মানবতা বেছে নিই

এই ঘটনার পেছনে কেবল একটি গাছ নয়, ছিলো একটি সমাজবোধের মৃত্যু। আমাদের সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতির জায়গা যত সংকুচিত হবে, তত বাড়বে বিভেদ, সহিংসতা, এবং অন্ধকার।

আমরা যদি এখনই না বলি, যদি এখনই এই চক্রকে থামাতে না পারি—তবে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য রেখে যাবো এক বিভক্ত, ভীতিপূর্ণ, অসহনশীল সমাজ।

আমরা কি তা চাই?

 শেষ কথা

সহনশীলতা আমাদের ঐতিহ্য। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা সংখ্যাগরিষ্ঠদের দায়িত্ব।
একটি গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়ে একটি সম্প্রদায়কে হুমকি দেওয়া যায়, কিন্তু তাদের বিশ্বাস, ইতিহাস ও মানবতা কেটে ফেলা যায় না।

আজ যদি আমরা সহনশীলতার পক্ষে দাঁড়াতে না পারি, তবে কাল কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *