জঙ্গিবাদ আসলে কার পক্ষে যায়

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত লড়াই চলছে। আপাতত থামার কোনো লক্ষণ নেই। আল কায়েদা দুর্বল হয়েছে তো ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান। সিরিয়ায় আইসিস পর্যুদস্ত হচ্ছে তো আফ্রিকায় বোকো হারামের অস্ত্র ঝনঝন করে উঠছে। আবার ওদিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের মধ্য দিয়ে নতুন সন্ত্রাসবাদ জন্ম নিচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জৌলুসপূর্ণ জনপদ। বার্লিনে ক্রিসমাস মার্কেটে গাড়ি তুলে দিচ্ছে তো প্যারিসে গুলি। বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে প্রাচীন মন্দিরের শহর সিরিয়ার পালমিরা। তুরস্ক দখলে নিচ্ছে সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে ঢাকাও রক্ষা পায়নি। গুলশানের হোলি আর্টিজানে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলা সবাইকে স্তম্ভিত করেছিল।

আধিপত্যবাদ ও দখলদারির জমিনে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস, বিবর্তনের পথে একটু হেঁটে আসা যাক। সন্ত্রাসবাদের কারণ এবং রাজনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক তালাশ করা প্রয়োজন। পশ্চিমের সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদী ধারণা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ শুরুর দিকের ও বর্তমান সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রের বিপরীত অবস্থানগত জায়গা থেকেই ১৯ শতকের শেষ দিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা সন্ত্রাসবাদ ধারণার সৃষ্টি করা হয়। পুঁজিবাদী উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় শক্তি এই ধারণার প্রচার ও প্রসার ঘটায়। মূলত পুঁজিবাদ ওই সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পিয়েরে বোর্দো, কাল মার্ক্স বা মিখাইল বুকানিনদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তনকামীরা ওই সময় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতিতে পরিবর্তন চাইছিল।

জার্মানির কার্ল হাইঞ্জ মনে করতেন, পরিবর্তনের জন্য সংঘাত, হত্যা বাঞ্ছনীয়। পরিবর্তনের কর্মীদের তিনি মুক্তিযোদ্ধা বলে উল্লেখ করেছেন। বিপরীতে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো এদের নৈরাজ্যবাদী ও সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়। আধুনিককালে সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত ধারণার বিস্তার সেই থেকে শুরু। তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের দ্বিতীয় ঢেউ আসে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর উপনিবেশগুলোতে সন্ত্রাসী তকমা পাওয়া স্বাধীনতাকামীরা সংগঠিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে নির্মম দমন-পীড়ন শুরু করে ঔপনিবেশিক শক্তি। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এর বিস্তার লক্ষ করা যায়। উপনিবেশবাদের পতন হলে সন্ত্রাসবাদের দ্বিতীয় ধাপেরও অবসান ঘটে।গত শতকের ৬০-এর দশকে নয়া বামপন্থীদের উত্থান ঘটে। এরা বুর্জোয়া শক্তিকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে মরিয়া হয়। ১৯৯০ সালে ঠান্ডাযুদ্ধের অবসান হলে এদেরও শক্তি কমে আসে। পশ্চিমারা এটাকে বলে সন্ত্রাসবাদের তৃতীয় ধাপ। সন্ত্রাসবাদের চতুর্থ ধাপে ধরন একেবারে পাল্টে যায়। তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদীরা মূলত রাজনৈতিক আদর্শের জায়গা থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করত। ৯০ পর্যন্ত পশ্চিমারা যাদের সন্ত্রাসী বলে মনে করত, তাদের বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক কর্মী। কেউ লড়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, কেউ যুদ্ধ করেছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।ইসলামের নাম করে চালানো সন্ত্রাসবাদই বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলেও পরিসংখ্যান ভিন্ন তথ্য দেয়। এফবিআই ডেটাবেইস থেকে বের হওয়া একটা প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৮০-২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। যুদ্ধাক্রান্ত সিরিয়াকে বাদ দিলে ২০১৬-১৭ সালেও বিশ্বের মোট সন্ত্রাসী ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে অমুসলিমদের দ্বারা (গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স ২০১৮)। কিন্তু সন্ত্রাসের প্রধান শিকার আবার মুসলিমরাই।সন্ত্রাসবাদের চতুর্থ ধাপে তথাকথিত ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার মুসলমানরাই বেশি হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৯০ থেকে আজ পর্যন্ত যত মানুষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বা আহত হয়েছে, তাদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই মুসলমান। সন্ত্রাসী হামলা সারা বিশ্বে হলেও বেশির ভাগ হামলা, যুদ্ধ হয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধের খরচ শীর্ষক গবেষণায় নভেম্বর মাসের হিসাব পর্যন্ত গত ২০ বছরের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সোমালিয়ায়, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ৮ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন ১৫ হাজার। ভিটেবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ।

মুসলমানরা হত্যা ও দখলদারির শিকার হলেও ৯/১১-পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দুটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে। রাজনৈতিক ইসলাম কি ব্যর্থ হয়েছে? ইসলাম রেডিকেল বা উগ্রপন্থী ধর্ম কি না? এই প্রশ্ন দুটোর মীমাংসা করলেই সন্ত্রাসবাদের সমাধানও মিলবে। ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন আছে। পূর্ববর্তী আব্রাহিমিক ধর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই ইসলাম নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো হাজির করেছে। ইসলামের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অনুধাবন করলে রাজনৈতিক ইসলাম ব্যর্থ কি না, এই আলোচনার অবসান ঘটবে।সন্ত্রাসবাদবিষয়ক গবেষক ইতালির অধ্যাপক অলিভার রয় জার্মানির অপরাধবিষয়ক ব্যুরোতে ২০১৫ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় বিস্তারিত আলোকপাত করেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে তিনি দেখিয়েছেন, একুশ শতকের সন্ত্রাসবাদীরা অনেকে আগে থেকেই ভিন্ন ধরনে উগ্রপন্থায় যুক্ত ছিল। এরা মাদক, যৌন ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল। ধর্মীয় অনুশাসন যে খুব করে পালন করত, তা না। হঠাৎ করেই ধর্মান্তরিত হয়ে বা ধর্মের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের অনুরক্ত হয়ে তারা সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে যায়। অলিভার রয় মনে করেন, ধর্ম এদের উগ্রপন্থী বানায়নি, বরং এরাই ধর্মকে উগ্রপন্থী বানিয়েছে।তালেবানদের হাত ধরে ইসলামী উগ্রপন্থার শুরু। আল কায়েদা ও আইএএসের হাতে উগ্রবাদ চরম আকার ধারণ করেছে। তবে আল কায়েদা ও আইএএসের সঙ্গে তালেবানদের পার্থক্য রয়েছে। তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতার ভাগ চায়। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। এ জন্য তালেবানরা দর-কষাকষিতে রাজি। তাই তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আল কায়েদা বা আইসিসের কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কর্মসূচি নেই। আইএসের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে দামেস্ক দখল করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত। সিরিয়ার কিছু অংশে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠত না। ইরাকে বাগদাদের খুব কাছাকাছি এসে ফিরে গিয়েছে আইসিস। বাগদাদ দখল করেনি। এমনকি সিরিয়ার কাছেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেলেও আইএস ও ইসরায়েলের মধ্যে বৈরিতা দেখা যায়নি। ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, আইসিস, আল কায়েদার মিশন হচ্ছে ইসলামকে বিতর্কিতভাবে, নৃশংসভাবে উপস্থাপন করা। রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে ইসলামকে দুর্বল করে রাজনৈতিক ইসলাম ব্যর্থ, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করার পথ করে দিচ্ছে আইসিসের সন্ত্রাসীরা।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *