দেশেজঙ্গী সংগঠন আবার সক্রিয়। অন্তবর্তী কালীন সরকার এই দিকে নজর দিবে তো?

সারা বিশ্বে আজ ধর্মীয় স্বাধীনতার আকাল চলছে। জঙ্গিবাদের উত্থান আতঙ্কজনক অবস্থায়। ধর্মের নামে তাদের তারা বিশ্বকে অশান্ত করে রেখেছে। বিশ্বে বর্তমানে ৭০০ কোটি মানুষের বাস। এই ৭০০ কোটি মানুষের সিংহভাগই কোনো না কোনো ‘ধর্ম’ লালন করেন, তথা ধর্মে বিশ্বাসী। তারা ‘আস্তিক’। তবে ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রচলিত ধর্মের প্রতি আস্থা রাখেন না, তারা ‘নাস্তিক’ হিসেবেই বিবেচিত। প্রাণিকুলের একমাত্র সভ্যতার দাবিদার মানুষ। বিশাল এই মানবগোষ্ঠীকে একমাত্র ‘ধর্ম’ই বহুধাবিভক্ত করে রেখেছে। কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদি, জৈন-শিখ ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মান্ধ নই, ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। চলমান কথিত বিশ্বসভ্যতার অবস্থান ঠিক এর বিপরীতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, আফ্রিকার কিছু দেশসহ আমাদের এই ভারত উপমহাদেশের দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে ইউরোপ-আমেরিকাও এর বাইরে নয়। সর্বত্রই ধর্মীয় উন্মাদনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পুরো পৃথিবীকেই অশান্ত করে রেখেছে এই উন্মাদনা। প্রতিদিনই অগণিত মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে ধর্মের নামেই। এমনই এক পৃথিবীতে আমরা বাস করছি যেখানে ধর্মীয় আচার পালনকালেও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। সারা বিশ্বেই স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করা অনেকটা অসম্ভবই হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। আমাদের দেশের কথাই বলি, মুসলমানরা তাদের ঈদ পালনেও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। হিন্দুরাও তদ্রুপ। তাদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে আতঙ্কভাব থাকে। প্রতিটি ধর্মীয় আচার পালনকালে ৩/৪ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয় রাষ্ট্রকে। বিষয়টি অবশ্য লজ্জার। অন্য ধর্মাবলম্বী, এমনকি ভিন্ন মত পোষণকারী একই ধর্মাবলম্বীরাও ক্ষেত্রবিশেষে আতঙ্ক ছড়ায়। শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে বোমাবর্ষণ হয়। হিন্দুদের মন্দিরগুলো নিরাপদ নয়। বৌদ্ধ বিহারে সন্ত্রাসী হামলা হয়। কেন আতঙ্কের মধ্যে ধর্মীয় আচার পালন করতে হচ্ছে, এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।আমাদের দেশে এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুল্লাহ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দল, লস্করে তৈয়বা, তালেবান নামের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী। আমাদের দেশে তালেবানী ছোবল ফেলার প্রচেষ্টা চলেছে কয়েক যুগ ধরে। সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির কারণে তারা তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবুও তাদের হাতে কম মানুষ নিহত হয়নি এদেশে। একযোগে ৬৩ জেলায় তারা বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আদালত, প্রেক্ষাগৃহ প্রভৃতি জনবহুল এলাকাতেও তারা হামলা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ভারতেও এরা পাখা বিস্তার করে রেখেছে। সেখানেও তারা বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। ভারতে ‘হিন্দু জঙ্গি’দের উত্থান হয়েছে। নিষিদ্ধ না করলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এরা নাশকতা চালাচ্ছে। এদের টার্গেট মুসলমান সম্প্রদায়। যদিও ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। ‘শিবসেনা’ নামের উগ্রবাদী সংগঠনটি ভারতকে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। গো-মাংস নিয়ে হত্যাযজ্ঞ এখন দেশটিতে সাধারণ বিষয়। বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমাদের পার্শবর্তী আরেকটি দেশ মিয়ানমার। সেখানকার বৌদ্ধ মৌলবাদীদের লোমহর্ষক ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। ‘বোকো হারাম’ নামের জঙ্গিগোষ্ঠী আফ্রিকার দেশগুলোকে অশান্ত করে রেখেছে। ‘আইএস’-এর তান্ডবে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ক্ষত-বিক্ষত। এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ঢেউ প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই আছড়ে পড়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের কারণে অস্থিরতার মধ্যে থাকে। নিকট অতীতে ফ্রান্স আইএসের নির্মমতার বলি হয়েছে কয়েকবার। এই আইএস খোদ আমেরিকারই সৃষ্টি। এর শীর্ষনেতা বাগদাদী আমেরিকার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে। তার প্রয়োজনীয়তা যখন ফুরিয়ে গেছে ঠিক তখনই তাকে হত্যা করে আমেরিকার সৈন্যরা। সারা বিশ্ব আজ ধর্মীয় উন্মাদনায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। আর এই অস্থিরতা চলছে ধর্মকে সামনে রেখেই। প্রতিটি ধর্ম সহমর্মিতাকে প্রশ্রয় দিলেও, এখন তা আর নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর দিকে তাকালে এর ভয়াবহতা লক্ষ করা যায়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোও ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রকাশ্যে ধর্মের অপব্যবহার না করলেও নেপথ্যে তাদের ভ‚মিকা বিশাল এবং মুখ্য।

আতঙ্ক সৃষ্টিকারী জঙ্গিবাদের সৃষ্টি ও উত্থান শক্তিধর দেশগুলোর মদদেই। বিশ্বের সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সৃষ্টি ওই শক্তিধরদের স্বার্থে। এর অন্তর্নিহিত কারণই হচ্ছে, তেল ও অস্ত্র ব্যবসা আর সম্প্রসারণবাদ নীতির মাধ্যমে ‘সৈন্য’ ব্যবসা। বিশ^ অশান্ত না হলে এই ব্যবসাগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে না। একমাত্র মানুষ মারার জন্য পরাশক্তিগুলো অস্ত্র বিক্রিতে মত্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববাসী ‘তালেবান’ নামের জঙ্গিদের তান্ডবে অতঙ্কগ্রস্ত ছিল। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন কাদের সৃষ্টি? বিশ্ববাসী এক বাক্যে আমেরিকার দিকেই আঙুল তুলবে। কেননা পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার মধ্যে লালিত লাদেনকে তাদের স্বার্থে তারাই সৃষ্টি করে। স্বার্থসিদ্ধির পর তার জীবনাবসানও হয়েছে আমেরিকারই হাতে। লাদেনকে ‘ইসলামী হুকুমত’ কায়েমের মতো একটি স্পর্শকাতর ইস্যু দিয়ে বিশ^বাসীর সামনে হাজির করা হয়েছিল। যদিও লাদেনের ধর্মীয় জ্ঞান ছিল সীমিত। মধ্যপ্রাচ্যের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর পরিবারে জন্ম নেওয়া লাদেন পশ্চিমা কৃষ্টি-সংস্কৃতির মধ্যে লালিত-পালিত। সেই লাদেনকে পাঠানো হয় কথিত ‘ইসলামী হুকুমত’ কায়েমের জন্য আফগানিস্তানে। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘তালেবান’ নামের জঙ্গি সংগঠনটি। সংগঠনটি সারা বিশ^কেই নাড়া দেয় আমেরিকার মতো দেশের ‘টুইন টাওয়ার’ ধ্বংসের মাধ্যমে। এতে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা তার সম্প্রসারণবাদী নীতির অংশ হিসেবে তালেবান নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে তাদের বিপুল পরিমাণ সৈন্য আফগানিস্তানে ঢুকিয়ে দেয়। তবু দীর্ঘ সময়েও আফগানিস্তান তালেবানমুক্ত হয়নি। যদিও আমেরিকার সেনারা পাকিস্তানের ভুখন্ডে ঢুকে তাদেরই সৃষ্টি ও আস্থাভাজন তালেবানের জনক লাদেনকে হত্যা করে। লাদেনের হত্যার মূল কারণই ছিল, তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়া। জঙ্গিনেতা লাদেনের তালেবানদের হাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। তারা এখনও আফগানিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশের পরিচয় তারা ‘মুসলমান’। আমেরিকার এই ঘৃণ্য নীতির বলি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। ইসলামী হুকুমতের কথা বলেই স্বজাতির হাতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ দেখছে বিশ্বসভ্যতা! আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানও রক্ষা পায়নি। ওই দেশেও জঙ্গিদের বিস্তার হয়েছে ব্যাপকভাবেই। যদিও পাকিস্তানিরা সৃষ্টিগতভাবেই সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মান্ধ। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে শুধু ধর্মীয় উপাসনালয়েই হত্যাকারীর শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।সারা বিশ্বের মানুষই আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের শিকার। মৌলবাদীদের অপতৎপরতায় বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষই রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ধর্মান্ধতা দূর করে আলোর পথ খুঁজতে হবে। এই মুহূর্তে প্রতিটি রাষ্ট্রে ধর্মীয় আচার পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে জঙ্গিবাদ দমন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *