কুসংস্কার উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতিবন্ধক

একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, আমাদের সমাজের অনেক মানুষ এখনো কুসংস্কারে নিমজ্জিত। এক্ষেত্রে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যেই কুসংস্কার লক্ষ্যণীয়। আজও গ্রামেগঞ্জে মেয়েদের শ্রী বা সৌন্দর্য বিচারের ক্ষেত্রে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী ইত্যাদি নিয়ে হাস্যকর বিভাজন চলে। এখনও অনেককে দেখা যায়, এক শালিক দেখলে দিন খারাপের অন্ধ বিশ্বাসে আচ্ছন্ন হতে। ঘর থেকে বেরোবার সময়, অসাবধানতাবশত হোঁচট খেলে বা হাঁচি পড়লে, কেউ কেউ খানিকটা বসে তারপর বাড়ি থেকে বের হন। অনেকেই ‘পেছন থেকে ডাকা অমঙ্গলকর’ এই কথাটাও যুক্তিহীনভাবে বিশ্বাস করেন। এরূপ হাজারো কুসংস্কার দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব কুসংস্কার মূলত সামাজিক জীবনের প্রতিবন্ধক এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্তরায়।কুসংস্কার এক ধরনের অন্ধবিশ্বাস হলেও একে সমাজ জীবনের অভিশাপও বলা চলে। অনেকে একে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে! যদিও মনের অজ্ঞানতা, যুক্তিহীনতা আর বিবেক-বুদ্ধির অভাব থেকেই কুসংস্কার এর জন্ম। প্রকৃতপক্ষে এর পেছনে কোনোরকম সত্যতা নেই। যুগযুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত মিথ্যা ধারণা, কিছু বানানো গল্পের মিথ্যা রটনা আর মনের অন্ধকারজনিত বিশ্বাসই এর মূলভিত্তি। যেমন সনাতন ধর্মে এক সময় সতীদাহ প্রথা নামক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। কুসংস্কারের প্রভাবে সমাজের পাশাপাশি মানবজীবনের অনেক ক্ষতি হয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অজ্ঞতা ও অশিক্ষা থেকে সৃষ্টি হয় যাবতীয় কুসংস্কারের। ফলে সমাজে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

আক্ষরিক অর্থে কুসংস্কার হলো অযৌক্তিক যেকোনো বিশ্বাস বা অভ্যাস যা মূলত অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়, বিজ্ঞান বা এর কার্যকারিতা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হওয়া, ভাগ্য বা জাদুতে ইতিবাচক বিশ্বাস অথবা যা অজানা তা থেকে ভয় পাওয়া। এছাড়াও ‘কুসংস্কার’ বলতে ধর্মীয় বিশ্বাস বা অযৌক্তিকতা থেকে উদ্ভূত কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। কুসংস্কার শব্দটি প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট সমাজের অধিকাংশের দ্বারা অনুসরণ না করা ধর্মের কথা বলে ব্যবহৃত হয়, যদিও প্রথাগত ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার রয়েছে কি-না তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। এটি সাধারণত ভাগ্য, ভবিষ্যদ্বাণী এবং নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক জগতের বিশেষ করে বিশ্বাস এবং অভ্যাসগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে এ ধারণাটি যে নির্দিষ্ট তা আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন আগের ঘটনাগুলো দ্বারা ভবিষ্যতের ঘটনাগুলোর জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে।সমাজে প্রচলিত কিছু বিষয়াদি রয়েছে যা বাহ্যত কুসংস্কারের মতোই মনে হয়। এসব কুসংস্কারের কোনো ধর্মীয় বা বৈজ্ঞানিকভিত্তি নেই। যেমন- ভ্রমণের প্রাক্কালে কোনো গাভী বা কুকুর হাঁচি দিলে এতে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা করা; ভ্রমণের প্রাক্কালে বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে বের হওয়াকে অশুভ বলে মনে করা; কোনো ভালো কাজের উদ্দেশ্যে বের হলে অকল্যাণ হতে পারে, এ ভয়ে পেছনের দিকে ফিরে না তাকানো; পরীক্ষায় শূন্য পাওয়ার ভয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকা; প্যাঁচা দেখলে বা এর আওয়াজ শুনলে এটাকে অশুভ মনে করা; রাতের বেলা ঘরের চালে বসে প্যাঁচা ডাকলে এতে বিপদের আশঙ্কাবোধ করা; বাংলা বর্ষ পঞ্জিকার বর্ণনা অনুযায়ী সপ্তাহের শনিবার, মঙ্গলবার ও অমাবশ্যার দিনকে অশুভ মনে করা এবং তাতে কোনো বিবাহ অনুষ্ঠান না করা; বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে দোকানে মাল বাকি বিক্রি করাকে অশুভ মনে করা; চল্লিশা পালন না করলে মৃত ব্যক্তির কবরে আজাব হয় বলে মনে করা; জমজ সন্তান হবার ভয়ে যুক্ত কলা খাওয়া থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।

কুসংস্কার নিয়ে বলতে গেলে আরো উল্লেখ করা যায়, ১৩ সংখ্যাটি অপয়া, ৪৯ সংখ্যাটি মস্তিষ্ক বিকৃতির, ৪২০ সংখ্যাটি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। অথচ বিশ্বাস করার আগে কেউ এর যৌক্তিকতা নিয়ে এতটুকু ভাবে না। এখনও শ্মশান বা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরও ভূতের ভয়ে গা কাঁপে। বিড়বিড় করে সৃষ্টি কর্তার নাম জপতে থাকে তারা। হয়তো নিজেরাও অবচেতনমনে জানে যে, সবগুলোই কুসংস্কার আর অবৈজ্ঞানিক ধারণা, কিন্তু এসব অবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোই দৈনন্দিন জীবনাচরণের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে, কোনোভাবেই এ বদ্ধমূল ধারণা থেকে তাদের মুক্ত করা যায় না।আসলে কুসংস্কার হলো এমন কাজ, কথা ও প্রথা মানা যার কোনো বাস্তব বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ভিত্তি নেই। মানুষের তৈরি যুক্তিহীন এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস, কথা, কাজ ও প্রথাকে সহজ বাংলায় কুসংস্কার বলা হয়। এসব কুসংস্কারে কারণে অনেকের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। আবার কোথাও কুসংস্কারের কবলে জীবনহানীর ঘটনাও ঘটে। কিছু কিছু কুসংস্কার তো সাধারণ বিবেকবিরোধী এবং রীতিমত হাস্যকর। কিছু মানুষ চরম অন্ধবিশ্বাসে এগুলোকে লালন করে। সমাজে প্রচলিত এসব কুসংস্কারের কারণে আল্লাহর ওপর আস্থা ও তার রহমতের প্রতি নির্ভরতা কমে যায়; চিরাচরিত ধর্ম বিশ্বাসে চিড় ধরে। মূলত: কুসংস্কার হলো ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরের প্রচলিত নিয়মবিধি- যার প্রতি মানুষ অন্ধবিশ্বাস স্থাপন করে সেই বিশ্বাসকে ভিত্তি করে জীবনে চলার চেষ্টা করে। কুসংস্কারজনিত অন্ধবিশ্বাসে পড়ে মানুষ নিজেদের ঈমানকে দুর্বল করে। বস্তুত মুসলমানের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসাই যথেষ্ট। ইসলামী শরিয়ত পরিপন্থী প্রচলিত এসব বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এছাড়া কুসংস্কার বন্ধের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো সবার ঈমানি দায়িত্ব। কুসংস্কার প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই, বরং তা শুভ বলে মনে করা ভালো। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! শুভ লক্ষণ কী? তিনি বললেন, এরূপ অর্থবোধক কথা, যা তোমাদের কেউ শুনতে পায়।’ (বোখারি শরিফ)।আমরা অনেকেই জানি ও বিশ্বাস করি, অজ্ঞতা ও অশিক্ষা থেকে সৃষ্টি হয় যাবতীয় কুসংস্কারের। ফলে সমাজে নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই অজানাকে জানতে হবে, অচেনাকে চিনতে হবে। যতদূর সম্ভব প্রতিটি বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। এজন্য চাই সঠিকভাবে জ্ঞান-অন্বেষণ ও বিদ্যার্জন। ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে অত্যাবশ্যক করা হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার বিকশিত হলেই সমাজ থেকে কুসংস্কার দূরীভূত হবে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না, তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (সূরা আল যুমার- ৯)।

সাধারণত গ্রামীণ এলাকার লোকজনের মাঝে কুসংস্কারের প্রভাব ও প্রবণতা একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে শহুরে লোকজন এসব থেকে মুক্ত এটাও বলা যাবে না। বড় বড় খোলোয়াড়, রাজনৈতিক নেতা, প্রসিদ্ধ লেখকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকদের মাঝেও কুসংস্কারের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তাদের সমাজ-সংসার, আচার-অনুষ্ঠান ও দৈনন্দিন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এসব মনগড়া প্রথা ও ভ্রান্ত রীতিনীতি অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। আল্লাহর বিধান ও হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দেখানো জীবনাচারের সঙ্গে এসব সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইসলামী শরীয়ত এসব কুসংস্কার ও কুপ্রথাকে বিশ্বাস করা হারাম বলে অভিহিত করে তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।হজরত রাসুলুল্লাহর (সা.) আগমনপূর্ব সময়কে কোরআনে কারিমে ‘আইয়্যামে জাহিলিয়াত’ বা অজ্ঞতা, ববর্রতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগ বলা হয়েছে। কারণ, তৎকালীন আরব সমাজ ছিল নানা কুসংস্কারের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। নারীকে যুগযুগ ধরে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। এ ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে মহান আল্লাহ হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) পাঠিয়ে ঘোষণা দেন যে, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসূলকে সঠিক পথ ও সঠিক তথা সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব মতবাদের ওপর এ ধর্ম তথা মতবাদ বিজয়ী হতে পারে। ’ (সুরা আত তাওবা : ৩৩)। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে ঘোর অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত এনে সে সমাজে ইসলামের জ্যোতি বিকীরণ করেন। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই যাবতীয় কুসংস্কার সমাজ থেকে কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পর তিনি তার দাওয়াতি কাজের সূচনায় জাহেলি যুগের সব কুসংস্কারকে পরিহার করে এক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলেন। ফলে সমাজ থেকে ধীরে ধীরে কুসংস্কারের প্রভাব কমতে থাকে- এমতাবস্থায়, তিনি নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়ে ইসলামের প্রচার করতে থাকেন।

ছোটখাটো বিষয়ে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না দেখা গেলেও আসলে মানবজীবনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। কুসংস্কারের প্রভাবে মনে যে সংকীর্ণতা দেখা দেয়, তা প্রতিফলিত হয় তার আচরণে, তার কাজকর্মে। যেমন, অজপাড়া গাঁয়ে এমন ধারণা আছে, ঘুম থেকে উঠে কিছুকিছু মানুষের মুখ দেখলে দিন খারাপ যায়। এর ফলে সৃষ্টি হয় মানুষে মানুষে বিভেদের আর শত্রুতার। তবে শুধু আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশেই যে কুসংস্কারের জয়জয়কার তা কিন্তু নয়, শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় সমৃদ্ধ অনেক জাতির মাঝেও কুসংস্কারের অস্তিত্ব রয়েছে। দেশে দেশে অবশ্য এই অন্ধবিশ্বাসের পার্থক্য রয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, মানব মন থেকে কুসংস্কারের এই জগদ্দল পাথরটিকে সরানো যদিও খুব একটা সহজ কাজ নয়, তারপরেও সর্বস্তরের মানুষদের মনের এ অন্ধকার বিশ্বাস দূরীকরণে এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে পর্যাপ্ত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে জোরপ্রচার চালাতে হবে। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব স্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক কুসংস্কার দূর করে আলোর পথ দেখতে হবে, সমাজকে নতুনভাবে গড়তে হবে, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ নিশ্চিত করতে হবে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *